এই সময়ে সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষের মধ্যে বিষণ্ণতা বাড়তে দেখা যাচ্ছে। আর তাই মানুষের প্রশ্নও বাড়ছে। কিভাবে বিষণ্ণতা থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। কিভাবে এটা প্রতিরোধ বা প্রতিকার করা যায়?

---প্রথম অংশ---

ডিপ্রেশন বা বিষণ্ণতা কি?

কোনো এক বা একাধিক ঘটনার প্রেক্ষিতে মানুষের মন খারাপ হয়। তবে সেই মন খারাপের মাত্রা কিংবা স্থায়িত্ব যখন স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি হয়ে যায়, তখন সেটিকে বলে ডিপ্রেশন বা বিষণ্ণতা।

ডিপ্রেশন কতটা ক্ষতিকর

বাহ্যিক দিক থেকে:

আর আধ্যাত্মিক দিক থেকে:

মানুষের মধ্যে ডিপ্রেশন (বিষণ্ণতা) বাড়ছে কেন?

আধুনিকতার নানা উপকরণে ভরে যাচ্ছে বর্তমান সভ্যতা। আর এগুলো নিয়ে অনেক মানুষের মাতামাতি পৌঁছে গেছে বাড়াবাড়িতে। এই আধুনিকতা নানা উপকরণ, যেমন: পোশাক, বাড়ি, গাড়ী, কম্পিউটার, স্মার্টফোন, ইন্টারনেট ইত্যাদি।

জ্ঞান, মনুষ্যত্ব, মানবিকতা, শালীনতা এরকম এসবের পরিবর্তে আজ মানুষ মানুষ মানুষকে বিচার করে অন্য কিছু দিয়ে, সেটা হলো, আধুনিক উপকরণগুলো যার যত বেশী আছে, সে ততটা আধুনিক ও সফল।

মানুষ তার আশেপাশের লোকদের সমান হতে ব্যাকুল--

এটা তো শুধু বাড়ির উদাহরণ, এইভাবে বিভিন্ন কিছুতে মানুষ একে অপরের প্রতিযোগী। শিশু, কিশোর, মধ্যবয়সী, বড়রা; পুরুষ এবং নারী সবাই কারো না কারো সমান হতে চায়, অথবা অন্য একজনকে টপকিয়ে তার চেয়ে বড় হতে চায়, তার চেয়ে বেশী কিছুর মালিক হতে চায়।

অন্যভাবে বললে এই সময়ে মানুষ আগের তুলনায় অনেক বেশী দুনিয়ামুখী। পৃথিবীতে কি কি অর্জন ও ভোগ করতে পারছি সেটা নিয়ে মানুষের মাথাব্যথা বেশী। অন্যের সম্পদ ও অবস্থা দেখে ইর্ষান্বিত হবার প্রবণতা বেশী।

সম্পদ অর্জন হারাম নয়। কিন্তু আজকের সমাজে সম্পদ এবং আধুনিকতার সামগ্রীগুলোর প্রতি মানুষের যে ঝোঁক বা ততৎপরতা সেটা অনেকটাই অসুস্থ। এখানে লোভ এবং জ্বিদ এই আকাঙ্খাগুলোকে অসুস্থ্য করে তুলেছে। যেখানে মানুষ আধুনিকতার জন্য নৈতিকতাকে বিসর্জন দিচ্ছে অনায়াসে। মানুষ আগেও সম্পদ আহরণ করতো। কিন্তু এখনকার পরিস্থিতি ভিন্ন। আর তাই বলা যায়, ডিপ্রেশন বা বিষণ্ণতার আধিক্যের পেছনে মূল কারণগুলো হলো:

---দ্বিতীয় অংশ---

স্বপ্ন-ভঙ্গের কষ্ট, হতাশা, ডিপ্রেশন বা বিষন্নতার এই মুশকিল থেকে বাঁচতে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে তুলে ধরার চেষ্টা করছি।

এখানে বেশ কয়েকটি বিষয় উল্লেখ করছি। সেগুলো আলাদা আলাদা দৃষ্টিকোণ। এগুলোর সবগুলো সম্পর্কে পরিস্কার ধারণা থাকা প্রয়োজন। তবে এর সবগুলো না হলেও, এগুলোর মধ্যে যে কোনো একটি বিষয়েও যদি কারো পরিস্কার ধারণা থাকে, তাহলেই তার স্বপ্ন-ভঙ্গের প্রচণ্ড কষ্ট, হতাশা, ডিপ্রেশন এগুলো থাকার কথা নয়। বিষয়গুলো হলো:

(১) আধুনিকতায় নেশাগ্রস্ত না হওয়া:

উপরে আধুনিকতা প্রসঙ্গে বলা হয়েছে। তো আধুনিকতাকে পুরোপুরী বর্জন করতে হবে - তা বলতে চাচ্ছি না। তবে,

(২) মানুষের দায়িত্ব-কর্তব্য:

এই পৃথিবীতে মানুষকে কেন পাঠানো হয়েছে, এখানে তার কাজ কি? - এটা নিয়ে ভেবে দেখা প্রয়োজন।

অতএব,
আমাদেরকে পরীক্ষার কথা মাথায় রাখতে হবে, মুসিলম হিসেবে জীবন যাপন করতে হবে, দায়িত্ব বুঝতে হবে। মোটকথা, ইসলাম আমাদের যে ভারসাম্যপূর্ণ জীবনের পথ দেখায়, সেভাবে জীবন যাপন করা শিখতে হবে।

(৩) আমাদের স্বপ্ন বা পরিকল্পনা:

তাহলে--

অতএব,
তাই আমাদের এই ধারণা থাকা উচিত যে, এই পৃথিবী মানুষের স্বপ্ন অনুজায়ী সাজানোর মোটেও উপযুক্ত কোনো যায়গা নয়। আর আল্লাহ্‌ তায়ালা মানুষের জন্য যে ভালো নির্ধারণ করেন, সেটা পার্থিবও হতে পারে পারলৌকিক ভালোও হতে পারে। সুতরাং নিজের স্বপ্ন বা পরিকল্পনা থাকতেই পারে। কিন্তু সেটার ব্যাপারে খুব বেশী একরোখা না হয়ে, নিজের স্বপ্ন বাস্তবায়নের প্রচেষ্টার পাশাপাশি, আল্লাহ্‌র ফয়সালার জন্য সবসময় প্রস্তুত থাকাও প্রয়োজন।

(৪) আখিরাত ও পৃথিবী:

আখিরাতের জীবনের তুলনায়, এই পৃথিবীর সময়কাল হলো, খুবই স্বল্প সময়।

আমাদের নবী (স.) এর ভাষ্য-- আখিরাতের জীবনের সময়কালের তুলনায়, এই পৃথিবীর জীবন হলো, সমুদ্রের পানিতে আংগুল ডুবিয়ে উঠালে যতটুকু পানি আংগুলে লেগে থাকে।

তাহলে এই পৃথিবীর জীবনটাকে, চলমান পৃথিবীর রীতি-রেওয়াজের সাথে সঙ্গতি রেখে সুন্দর করার চাইতে, এটাই কি ভালো নয়, যাতে পরকালীন জীবনটা সুন্দর হয়। আর তার জন্য আমাদের এই পৃথিবীতে সেইভাবে চলতে হবে, যেইভাবে চললে আল্লাহ্‌ আমারা উপর খুশী হন।

(৫) সবর:

মানুষকে তার স্বপ্ন সাজাতে এই পৃথিবীতে পাঠানো হয়নি। মানুষকে এই পৃথিবীতে পাঠানো হয়েছে, পরীক্ষা নেয়ার জন্য। সেই পরীক্ষায় সে কতটা ভালো করছে, তার উপর নির্ভর করছে তার পরবর্তী জীবন। তাই পরবর্তী জীবনের জন্য প্রস্তুতি পর্ব বলা যায় এই পৃথিবীর জীবনকে।

(৬) ইসলাম সম্পর্কে পরিস্কার ধারণা:

ইসলাম অনুশীলনের কথা আসলে আমরা অনেকেই ভয় পাই।

ইসলামে বিনোদন আছে, ইসলামের নিজস্ব সংস্কৃতি রয়েছে, ইসলামে রয়েছে সম্পূর্ণ অর্থনৈতিক ব্যবস্থাও। তবে সব কিছুতে ইসলামের নির্দিষ্ট দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে, সেগুলো অনুসরণ করতে হবে।

ইসলাম দুনিয়া এবং আখিরাত দুটোরই সমাধান দেয়। আর আল্লাহ্‌ তায়ালা আমাদের শিক্ষা দিয়েছেন দোয়া করতে,

"রব্বানা আ-তিনা ফিদ্দুনিয়া হাসানাতাওঁ ওয়াফিল আ-খিরাতি হাসানাতাওঁ ওয়াকিনা ‘আযা-বান্না-র"
অর্থঃ হে আমাদের রব্ব! আমাদেরকে দুনিয়াতে কল্যাণ দিন এবং আখেরাতেও কল্যাণ দিন এবং আমাদেরকে আগুনের শাস্তি থেকে রক্ষা করুন।

ইসলাম সম্পর্কে আমাদের অনেকের মধ্যে ধারণা পরিস্কার নয়। আমরা মুসলিম পরিবারে জন্ম নেয়া মুসলিমরা বেশীরভাগই ইসলামকে জানিনা। যার ফলে দূর থেকে ইসলামকে একটু আধটু জানি এবং একে দেখে ভয় পাই। দূরে দূরে থাকি। তাই আমাদের প্রয়োজন ইসলাম সম্পর্কে জানা। আর সে লক্ষ্যে আমদের উচিত:

(৭) অন্তর বা মনের খোরাক:

ডিপ্রেশন আমাদের মনকে বিষাক্ত করে তুলতে পারে, নিরাশ করে তুলতে পারে, অস্থির করে তুলতে পারে। অন্যদিকে মন আর অন্তরের খাদ্য হলো আল্লাহর যিকর (বা আল্লাহ্‌র স্মরণ)। তাই আল্লাহ্‌র যিকর আমাদের মনকে প্রশান্তি দিতে পারে। আল্লাহ্‌র যিকরের বিভিন্ন উপায় বা পদ্ধতির মধ্যে অন্যতম হলো:

(ক) কুরআন তিলাওয়াত।

(খ) আল্লাহ্‌র যিকরের আর একটি পদ্ধতি হলো সকাল ও সন্ধ্যার নির্দিষ্ট কিছু অনুশীলন। যেগুলো আল্লাহ্‌র নবী (স.) আল্লাহ্‌র কাছে নিবেদন করতেন। সেই আমলগুলো করা যেতে পারে প্রতিদিন সকাল-সন্ধ্যায়।

(৮) রাসুল (স.) এর জীবন থেকে:

আমাদের নবী (স.) এবং তাঁর সাহাবাদের জীবন থেকে নেয়ার মতো অনেক কিছুই আছে। যা দিয়ে আমরা আমাদের জীবনকে জাঁক জমকপূর্ণ হোক বা না হোক, মানসিক প্রশান্তিময় করতে পারি। আমরাআমাদের জীবনকে বানাতে পারি হতাশামুক্ত। পৃথিবীর জীবনকে প্রশান্তিময় করার পামাপাশি আখিরাতের দীর্ঘ জীবনের উপযুক্ত।

(৯) আল্লাহ্‌ তায়ালার উপর আস্থা রাখা:

'আশা করা' তথা আল্লাহ্‌র প্রতি আস্থা - মানুষকে ইমানের পথে রাখে, যার মাধ্যমে দুনিয়া ও আখিরাতে সফল লাভ হয়।

অন্যদিকে, হতাশা - কুফরীর দিকে নিয়ে যায়। কুফরী হলো আল্লাহ্‌ নেয়ামত অস্বীকার ও আল্লাহ্‌র রহমত পাবার ব্যাপারে অবিশ্বাস। তাই হতাশার মাধ্যমে শয়তান তাকে জাহান্নামের দিকে এগিয়ে দেয়ার সুযোগ পায়।

মনে রাখতে হবে:

---তৃতীয় অংশ---

উপরের এই বিষয়গুলো সম্পর্কে ধারণা থাকার পাশাপাশি, আল্লাহ্‌র সাহায্য চাওয়া প্রয়োজন। আর তার জন্য সেরা কিছু আমল হলো:

---চতুর্থ অংশ---

বাহ্যিকভাবে করণীয়:

আত্মহত্যার ব্যাপারে ইসলাম:

একজন বিশ্বাসী কখনো মৃত্যু প্রত্যাশা করতে পারে না, তার সমস্যা থেকে পালানোর জন্য। তার দোয়া করা উচিত: নবী (স.) দোয়া করতেন, আল্লাহ্‌ আমাকে ততদিন বাচিয়েঁ রাখুন যতদিন সেটা আমার জন্য ভালো। তখন আমাকে নিন, যখন আমার জন্য চলে যাওয়া ভালো।

ডিপ্রেশনের পেছনে নির্দিষ্ট কিছু পরিস্থিতি এবং সেগুলোতে করণীয়:

পরিশেষে,

আমাদের মন খারাপ হবে, সেটা স্বাভাবিক। কিন্তু সেটার সাথে আমরা কি আচরণ করছি সেটাই দেখার বিষয়। মন খারাপের বিষয়টাকে মনে স্থান দিলে, সেটা নিয়ে ভাবতে থাকলে, তা আমাদের কোনো উপকার করে না বরং আমাদের ইহকাল এবং পরকাল উভয়টাকেই নষ্ট করে ফেলে। অন্যদিকে আছে 'সবর'। দূর্ঘটনা ঘটলে, আল্লাহ্‌র ফয়সালা হিসেবে সেটাকে মেনে নিয়ে সেটাতে ধৈর্য ধারণ বা সবর করার অর্থ হলো, আল্লাহ্‌র সিদ্ধান্তে সন্তুষ্ট থাকা। তাহলে আল্লাহ্‌ তায়ালাও আমাদের উপর সন্তুষ্ট হবেন। আর তাতে আমাদের ইহকাল সহজ হয়ে যাবে এবং পরকালও সুরক্ষিত থাকবে।