বিজ্ঞান আর টেকনোলজি নিয়ে বর্তমান সভ্যতার গর্বের শেষ নাই। ভাবটা এমন, যেনো "আল্লাহ্কে টেক্কা দিয়ে ফেলেছি" (নাউযুবিল্লাহ)। সেই সভ্যতার অনেক কিছুকেই কোনঠাসা করে দিলো কোভিড-১৯ করনাভাইরাস। চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিলো মানুষ কতটা দুর্বল।
আল্লাহ্র গজব, মানুষের কর্মফল যেভাবেই দেখা হোক না কেনো। "করোনাভাইরাস" আজ এমন একটি নাম, যারা প্রভাবে আজ সারা বিশ্বের প্রায় প্রতিটি মানুষ গৃহবন্দি। বিপদ-দূর্যোগ তো আমরা আগেও দেখেছি । কিন্তু, একযোগে সারা বিশ্ব! সব জনপদ! সব শ্রেণী-পেশার মানুষ! - এমনটা সচরাচর হয়না। এই মুহূর্তে আমরা যারা বেঁচে আছি এই পৃথিবীতে, তাদের কেওই বোধহয় এমনটা দেখিনি।
কেও বলছে এটা আল্লাহ্র গজব, কেও বলছে জীবানু অস্ত্র, কেও বলছে বাদুড় থেকে এসেছে, কেও বলছে ও-দেশ দায়ী, কে বলছে সে-দেশ দায়ী। যেটাই সত্য হোক না কেন, ভাবছি এটার প্রভাব নিয়ে।
এই মহামারীতে তুমি কি ভাবছো?
যে কথাগুলো আমার মাথায় আসছে--
চিকিৎসা বিজ্ঞান নিয়ে আমরা যে এতো গর্ববোধ করি, সত্যিই কি খুব গর্বের? চলচ্চিত্রে দেখানো হয় এর চাইতে অনেক আজব ধরণের জীব। সেগুলো আকারে অনেক বড়, শারীরিক দিক থেকে অনেক শক্তিশালী। কিন্তু এই "করোনাভাইরাস" তো সেগুলোর মতো আকারেও বড় নয়, আবার এটা শরীরে প্রবেশ করে সেরকম বড় কোনো কাজও করছে না, যেমনটা চলচ্চিত্রে দেখানো হয়। এতে মৃত্যুর হারও সামান্য। তারপরও এতো বড় বড় হাসপাতাল, গবেষণাগার, এতো মেডিকেল সেটআপ, সবকিছুর পরেও আমাদের চিকিৎসা বিজ্ঞান অসাহায়ত্ব প্রকাশ করতে বাধ্য হলো না কি?
তারপরও কি আমাদের ভাববার নয় যে, কতটা দুর্বল আমাদের এই কথিত "উন্নত চিকিৎসা বিজ্ঞান"! তুমি কি ভাবছো?
যোগাযোগ আর টেকনোলজি নিয়ে আমোদের গর্বের শেষ নাই। আমরা মনে করি যে এই টেকনোলজির মাধ্যমে আমরা অনেক অনেক শক্তিশালী হয়ে গেছি।
আমরা জানি, এই ভাইরাস প্রথমে একটা মাত্র এলাকায় প্রকাশিত হলো, সেখান থেকেই সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে গেলো।
আমাদের উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা আছে, অথচ বুঝতে পারার পরপরই নাকি বলা হয়েছিলো যে, "চুপ হয়ে যাও"। কেন বলা হয়েছিল সেটা নিয়ে বিতর্ক থাকতে পারে, যুক্তি যাই হোক। বলতে হলো চুপ হয়ে যেতে; বলা গেলো না যে সবাইকে সাবধান করো। যে চুপ করাতে বললো, তার কোনো না কোনো দুর্বলতা তো আছেই। সে যেটাই হোক না কেন, সেই দুর্বলতা বা স্বার্থের কাছে হেরে গেলো মানবতা।
পরে যখন সবাইকে জানিয়ে দেয়া হলো, পরীক্ষা করা শুরু হলো। বিমান যোগাযোগ বন্ধ করে, কোনো ধরণের টেকনোলজি দিয়ে, কোনো সতর্কবাণী দিয়ে, কিছুতেই আটকিয়ে রাখা গেলো না। ছড়িয়ে গেলো পুরো পৃথিবীতে।
দ্রুতগতির সেই বিমানগুলো আছে আজও। কিন্তু কয়েকমাস আগের মতো, চাইলেই বিমানের টিকেট নিয়ে পাড়ি জমাবো সেটা আজ সম্ভব না।
উন্নত দেশগুলোর সম্পর্কে আমরা একটু অন্যরকম ধারণা পোষণ করি। তাদের সব ব্যবস্থাপনা উন্নত, পরিবেশ উন্নত, নাগরিকরা শিক্ষিত এবং শৃঙ্খলাবদ্ধ, যোগাযোগ ববস্থা, ট্রাফিক ব্যবস্থা সবকিছুই উন্নত। অথচ দেখো সেই উন্নত দেশগুলোতেও ছড়াছড়ি হয়ে গেলো এই ভাইরাস। ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ করে দিয়ে জনসাধারণকে ঘরের মধ্যে পুরে দিয়ে, তাদের কর্তা ব্যাক্তিরা বাধ্য হচ্ছে ক্যামেরার নামনে অসহায়ত্ব স্বীকার করতে।
ধনী-গরীব, বড়-ছোট সবাই অসহায় বোধ করছি, এই করোনাভাইরাস জনিত পরিস্থিতিতে। তারপরও কি আমাদের ভাববার সুযোগ হবে না যে, আমরা তথাকথিত উন্নত টেকনোলজির যুগের মানুষরা 'আমরা কতটা দুর্বল', 'আমাদের বিজ্ঞান বা টেকনোলজি কতটা অসহায়'!
বিশ্ব মোড়লরা যারা 'সন্ত্রাসী' নাম দিয়ে নিরীহ মানুষদের উপর অত্যাচার চালিয়ে আসছে, তারা কি স্বস্তিতে আছে? ইরাক, আফগানিস্তানসহ আরব দেশগুলোতের আক্রমণ পরিচালনার ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহৃত মার্কিন রণতরী থিওডোর রুজভেল্ট, যার অবস্থান কিনা সাগরের মাঝে, সেটাও রেহায় পায়নি এই ভাইরাস থেকে।
গতিশীল জীবনযাত্রা: গতিশীল জীবনযাত্রার অংশ ছিলাম আমরা, এই তো ক'দিন আগেও।
দুর্বার গতিতে ঘোড়া তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছিলাম। আজ সেই ঘোড়ার লাগাম টানতে বাধ্য হয়েছি সবাই। আজ তো ঘোড়াটা ঝিমাচ্ছে, এই অবসরে গভীরভাবে চিন্তা করার সুযোগ পেয়েছি, সুযোগটা ছেড়ে দেয়া ঠিক হবে না। মোবাইল-ল্যাপটপ-টিভি নিয়ে ব্যাস্ত থেকে, বাস্তবতাকে ভুলে থাকার চেষ্টা না করে। আসুন বাস্তবতাকে বুঝি, একটু চিন্তা করি-
এই যে দুরন্ত ছুটে চলা, এর চুড়ান্ত লক্ষ্য কি? একটা ভালো ডিগ্রী, তারপর একটা ভালো জিবিকার সাথে যুক্ত হওয়া, তারপর একটা সুন্দর বাড়ি, একটা গাড়ী.... আসলে চুড়ান্ত লক্ষ্য কোনটা? সমৃদ্ধি?
কিন্তু যারা সমৃদ্ধ তারা কেন সন্তুষ্ট হয় না - মৃত্যু না আসা পর্যন্ত?
বিগত জীবনে অনেক কিছুই চেয়েছি কিন্তু পাইনি। ভবিষ্যত জীবনে যা যা চাচ্ছি সে সবই পেয়ে যাবো ভাবার কোনো কারণ আছে কি?
একবার থেমে দাঁড়িয়ে ভাবা উচিৎ নয় কি?
মহামারীর এই অবসরে ভাবার সময় এসেছে-- আজও যদি না ভাবি, হয়তো জীবনে শেষ মূহুর্তে গিয়ে পস্তাতে হবে, 'সারাটা জীবনের দৌড় ছিলো শুধুই মরিচিকার পেছনে'।
আসুন আর একবার নিজেদের দিকে তাকাই-
আমরা সবাই নিজ নিজ লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে শঙ্কিত।
এই মহামারীর পরিস্থিতিটা না হলে আমি এতোদিনে অতটুকু এগিয়ে যেতাম। ঐ কাজটা হয়ে যেতো। হায়! তাড়াতাড়ি যদি এই দুর্যোগের সমাপ্তি না হয়, তাহলে কি হবে আমার লক্ষ্যের..............!
জীবনে লক্ষ্যমাত্রা থাকাটা সমস্যা নয়। সমস্যা হলো, এগুলোর পেছনে লেগে থাকার প্রক্রিয়াটা। প্রথমত, আমরা পার্থিব এই চাওয়াগুলোর পেছনে সময় আর মনোযোগ দিতে গিয়ে আল্লাহ্কে সময় দেই না পর্যাপ্ত। কুরআন ছুঁই না, নামাজ পড়ি না, পড়লেও গাছাড়াভাবে পড়ি। দ্বিতয়িত, এই লক্ষ্য অর্জনের সার্থে বিভিন্ন অনৈতিক উপকরণকে বৈধ বানিয়ে ফেলি। আর তৃতীয়ত, মানুষের অধিকার হরণ করাকে আমরা পাপ বলে মনেই করছি না। নিজেরা কখন জালেমে পরিণত হয়েছি বুঝতেই পারিনি।
কোন পাপটা আমার জীবনের সাথে আষ্টে-পৃষ্টে জড়িয়ে আছে? নিজেরটা নিজেকেই অনুধাবন করতে হবে। আমরা অনেকেই নিজের দোষগুলো জানি কিন্তু সেটাকে পাপ বলে স্বীকার করিনা, নিজের সাথে ছল-চাতুরী করি। বিভিন্ন যুক্তি দাঁড় করিয়ে সেগুলোকে হালাল করে নিই। আবার অনেকে হয়তো না জেনে করছি।
নিজের পাপগুলো আজ বাদ দিতেই হবে আমাকে। ভয় এই পরিস্থিতিকে নয়, আসুন ভয় সেই সত্বাকে করি যিনি আমাদেরকে পৃথিবীর কঠিন পরিস্থিতি থেকে উদ্ধার করার ক্ষমতা রাখেন। আমাদের প্রকৃত মঙ্গল কিসে, সেটা আমাদের চেয়ে ভালো বোঝেন। আমাদেরকে পুরস্কৃত করার ক্ষমতা রাখেন।
আর হ্যাঁ--
আমরা সরকারী নির্দেশনা মানছি, সেচ্ছায়, কিংবা বাধ্য হয়ে। কিন্তু আল্লাহ্র কত শত নির্দেশনা উপেক্ষা করে যাচ্ছি। সরকারের নির্দেশ না মানলে তাৎক্ষণিক শাস্তি। কিন্তু আল্লাহ্র শাস্তি জমা থেকে যাচ্ছে।
আত্মসমর্পন:
সবকিছু স্বাভাবিক হবে সেই প্রতাশা করছো। আমাদের কামনা-বাসনার উপর ভিত্তি করে পৃথিবীটা চলছে না, চলে না। এখানে জালেমদের জুলুমের প্রভাব আছে। আছে আল্লাহ্র পরীক্ষা। আমার অসুখ হলো, এর মানে এটা নয় যে আল্লাহ্ আমার প্রার্থনা মঞ্জুর করলো না। আবার, আমার অসুখ হলোনা এটার মানে এই নয় যে আল্লাহ্ আমাকে ভালোবাসলো। বরং, আমার বিপদের মাধ্যমে হয়তো আল্লাহ্ আমার পরীক্ষা নিচ্ছেন, আমার কষ্টের বিনিময়ে আল্লাহ্ হয়তো আমার জন্য সুন্দর ভবিষ্যত দিতে পারেন।
মৃত্যু হতে পারে করোনায়, তেননি হতে পারে হার্ট এ্যাটাকে, অন্য কোনোভাবেও হতে পারে। তার পরই কবরের জিন্দেগী শুরু, সেখানের জীবনটা আরামের হবে াকি কষ্টের সেটা নির্ভর করছে, আমার পৃথিবীর সারাটা জীবন আমি কিভাবে কাটিয়েছি তার উপর। বিগত জীবনে পাপ করেছি সে কার আর ক্ষমার সুযোগ নাই - এমনটা বাবার কোনো কারণ নাই।
তাই আল্লাহ্র সিদ্ধান্তের উপর ভরসা রেখে, আল্লাহ্র কাছে আত্ম সমর্পনই করার এটাই হতে পারে সুবর্ণ সুযোগ।
মৃত্যু যখন সামনে এসে দাঁড়ায় সেই সময় তওবা কবুল করেন না আল্লাহ্ তায়ালা।
কিন্তু যতক্ষণ মৃত্যু আমার সামনে হাজির হয়নি - ততক্ষণ; যতক্ষণ আল্লাহ্র আযাব সরাসরি আমার সামনে হাজির হয়নি - ততক্ষণ; ততক্ষণই সুযোগ ফিরে আসার। ততক্ষণ পর্যন্তই সুযোগ, বিগত দিনের পাপাকাজের জন্য অনুতপ্ত হয়ে, ভবিষ্যতে আর সেগুলো করবো না বলে প্রতিজ্ঞা করার।
নিজেকে পরিবর্তন করতে আগ্রহী? -> মহামারীতে করণীয় - লকডাউনকে কাজে লাগান
পরিশেষে,
তাই বর্তমান পরিস্থিতিকে আল্লাহ্র সতর্ক সংকেত ভাবি। সতর্ক সংকেত ভেবে, আল্লাহ্র কাছে আত্মসমর্পন করি। আরো বড় কোনো দূর্যোগ আসার আগেই, হঠাৎ মৃত্যু হওয়ার আগেই, আরো বড় কোনো বিপদ আসার আগেই আল্লাহ্র কাছে ক্ষমা চাই।
আসুন, পাপমুক্ত জীবনকে বেছে নেই।
দারিদ্রকে মেনে নিতে হোক, তবুও পাপমুক্ত জীবন চাই।
স্টাটাসহীন হোক, তবুও পাপমুক্ত জীবন চাই।
আনস্মার্ট বলুক লোকে, তবুও পাপমুক্ত জীবন চাই।
__________
__________